নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা আগে ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনো বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত। মেঘনার অববাহিকায় বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জন্ম নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষা ও আতিথেয়তার বেশ সুনাম। দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের মনেও জায়গা করে নিচ্ছে এ জেলার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র।
নিঝুম দ্বীপ
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী তথা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র। নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। ১৯৪০-এর দশকে এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠা শুরু করে। চর গঠনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ৪০-এর দশকের শেষদিকে নিঝুম দ্বীপ তৃণচর বা গোচারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুম দ্বীপ আবিষ্কার করে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুম দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুম দ্বীপে আসে। সমস্ত নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৩০০০ একরে মানুষের বসতি রয়েছে এবং জনগণের নিকট নিঝুম দ্বীপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও হরিণ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ।
বজরা শাহি মসজিদ
৩০০ বছরের মোঘল স্থাপত্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন বজরা মসজিদ। ১৭৪১ সালে মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর রাজত্বকালে তার নির্দেশে ও অর্থে মিয়া আন্বরের সহযোগিতায় জমিদার আমান উল্যাহ খান দিল্লির শাহি মসজিদের অনুকরণে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। জমিদার আমান উল্যাহ তার বাড়ির সম্মুখে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পাড়যুক্ত একটি বিশাল দিঘি খনন করেন। দিঘিটির পশ্চিম পাড়ে মনোরম পরিবেশে আকর্ষণীয় তোরণ বিশিষ্ট প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু ৩ গম্বুজ-বিশিষ্ট এ ঐতিহাসিক মসজিদখানা নির্মাণ করেন।
এই মসজিদটিকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভিত তৈরি করা হয়। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দ্বারা গম্বুজগুলো সুশোভিত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে ৩টি ধনুকাকৃতি দরজা। মসজিদের প্রবেশ পথের ওপর রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। কেবল দেয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিহরাব আছে।
কমলার দীঘি
হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের মানুষ ঘোরাঘুরি বা অবসর সময় কাটানোর জন্য সবচেয়ে বেশি যে জায়গাটি ভ্রমণ করেন, তা হলো কাজির বাজার এলাকার কমলার দীঘি। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ জায়গাটির এক পাশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন, আরেক পাশে রয়েছে ঝাউবন, সুবিশাল মাঠ, বনভূমি এবং অন্য পাশে রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র।
জোয়ারের সময় এখান থেকে উপভোগ করা যাবে সমুদ্রের গর্জন, আর ভাটার সময় বিস্তীর্ণ বালিরাশি ও সমুদ্রের সৌন্দর্য। তা ছাড়া এখান থেকে সমুদ্র চলমান শত শত জাহাজের সারি দেখা যায়। সূর্যাস্তের সময় কমলার দীঘির চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শরীর ও মন জুড়ানো শীতল বাতাসের কারণে প্রতিদিন এখানে এ এলাকার লোকজনের ভিড় জমে।
শীতকালে প্রায় প্রতিদিন এখানে হাতিয়ার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবারের লোকজন পিকনিক করতে আসে। তা ছাড়া বছরের যে কোনো সময় এ জায়গাটিতে ভ্রমণ করা যায় এবং এর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ওসখালী বাজার থেকে মোটরসাইকেল বা সিএনজি যোগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যেই কমলার দীঘিতে পোঁছানো যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বিচ-সংলগ্ন বাগানগুলোতে শিয়ালের হাঁকডাক সৃষ্টি করে সুমিষ্ট সুরের লহরি।
গান্ধী আশ্রম
গান্ধী আশ্রম নোয়াখালী জেলার মাইজদী কোর্ট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোনামুড়ী উপজেলার জয়াগ বাজারের কাছে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রয়াত জমিদার ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে স্থাপিত গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর একটি সেবামূলক সংগঠন হিসেবে সারা দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সমাজ ব্যবস্থার ধারণাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে ২০০০ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। গান্ধীর বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, বই, ব্যবহার্য জিনিস এবং তার বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন যে কারো মনোজগৎ নাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
চেয়ারম্যান ঘাট
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার প্রবেশপথ চেয়ারম্যান ঘাট। যা ইলিশের মৌসুমে বেশ জমজমাট হয়ে উঠে। সুর্যোদয় সূর্যাস্ত আর ইলিশের হাঁকডাক ভ্রমণপিপাসুদের মনেও জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গে আছে মেঘনার বিশাল ঢেউ। চারদিকে থইথই করে পানি।
চেয়ারম্যান ঘাটে রুপালি ইলিশ খেতে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন অসংখ্য মানুষ। ইলিশের দাম এখানে তুলনামূলক কম হওয়ায় চাহিদা মোতাবেক ভেজে বা রান্না করে পরিবেশন করা হয় গরম ভাতের সঙ্গে। আবার কেউ কেউ মুড়ি দিয়ে খায় ইলিশ ভাজা। এ ছাড়া আছে গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, মাছের ডিম ভাজা, লেজ ভর্তা, বেগুনের চপ, স্থানীয় পান, দই, মিষ্টি ও চা তো আছেই।