ইতিহাসের পাতায় মুসলিম পর্যটকদের অবদান অসামান্য। হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের একটি ধারাবাহিক যাত্রা শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ আগ্রহে ভ্রমণ করেছেন এবং কেউ কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই বিভিন্ন বিখ্যাত মুসলিম পর্যটকদের জীবনযাত্রার প্রকৃতি বর্ণনা করার এবং পরবর্তীকালে সেগুলোকে লিপিবদ্ধ করার একটি প্রবণতা দেখা দেয়।
বিখ্যাত এই মুসলিম পর্যটকরা শুধু ভ্রমণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তাঁদের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও লেখনী দ্বারা বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের ভ্রমণকাহিনি জ্ঞানের জগতে এক অমূল্য সম্পদ
সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল তাদের এই ভ্রমন । নিচে বিখ্যাত ১০ জন বিখ্যাত মুসলিম পর্যটকের জীবনী এবং তাঁদের সফরনামা বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরা হলো—
১. ইবনে বতুতা (১৩০৪-১৩৭৭)
ইবনে বতুতা ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক। তাঁর পুরো নাম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আল-তানজি।
তিনি মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ইবনে বতুতা মরক্কো, মিসর, সুদান, লেভান্ট, হিজাজ, ইরাক, পারস্য, ইয়েমেন, ওমান, বাহরাইন, তুর্কমেনিস্তান, ট্রান্সক্সিয়ানা, ভারত, চীন, জাভা, মধ্য আফ্রিকাসহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। ৩০ বছর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তাঁর ‘তুহফাহ আন-নাজ্জার ফি গারায়িব আল আমসার ওয়া আজায়িব আল আসফার’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থ ‘আর রিহলাহ’ নামে পরিচিত।
২. আল-ইদ্রিসি (১১০০-১১৬৫)
আল-ইদ্রিসি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভূগোলবিদ ও কার্টোগ্রাফার।
তিনি সিসিলির রাজা রজারের অনুরোধে একটি বিস্তৃত মানচিত্র ও ভ্রমণকাহিনি ‘নুযহাতুল মুশতাক’ রচনা করেন। আল-ইদ্রিসির মানচিত্র মধ্যযুগীয় ইউরোপে এবং ইসলামী বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত হতো। তাঁর মানচিত্রে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়।
৩. আল-মাসুদি (৮৯৬-৯৫৬)
আল-মাসুদি একজন বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক ও পর্যটক ছিলেন।
তিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুরুজ আল-জাহাব’ (স্বর্ণের তৃণভূমি) বিশ্ব ইতিহাস ও ভূগোলের ওপর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ।
৪. ইবনে জুবায়ের (১১৪৫-১২১৭)
ইবনে জুবাইর একজন আন্দালুসিয়ান পর্যটক ও লেখক ছিলেন। তাঁর পুরো নাম আবু আল-হাসান মুহাম্মদ বিন আহমেদ বিন জুবায়ের আল-কিনানি, যিনি ইবনে জুবায়ের আল-আন্দালুসি নামে পরিচিত। তিনি একজন আন্দালুসিয়ান-আরব ভূগোলবিদ, ভ্রমণকারী, লেখক ও কবি। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘রিহলাতু ইবনে জুবায়ের’ নামে পরিচিত।
তিনি মক্কা, মদিনা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। তাঁর লেখায় হজ্জযাত্রা এবং সেই সময়ের ইসলামী বিশ্বের সংস্কৃতি ও সমাজের বিবরণ পাওয়া যায়। ভ্রমণকালে তিনি যেসব শহর অতিক্রম করেছেন, যেসব আশ্চর্য ঘটনা ও স্থাপনা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নৈতিক ও রাজনৈতিক যে অবস্থা দেখেছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। বিশেষ করে ধর্মীয় দিককে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। বিভিন্ন মসজিদ, সমাধি, সাহাবিদের কবর, হজ যাত্রা, ওয়াজ-নসিহতের মজলিস, হাসপাতাল ইত্যাদির বিবরণ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি প্রাচ্যের ভূমিতে মুসলিম ও ক্রুসেডারদের ঘটিত যুদ্ধের বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন।
৫. ইবনে ফাদলান (৮৭৯-৯৬০)
ইবনে ফাদলান একজন আব্বাসীয় কূটনীতিক ও পর্যটক ছিলেন। তিনি বাগদাদ থেকে ভলগা বুলগেরিয়ায় একটি রাষ্ট্রদূতীয় মিশনের অংশ হিসেবে ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘রিসালা ইবনে ফাদলান’ নামে পরিচিত, যেখানে তিনি উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর লেখনীতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভলগা বুলগেরিয়ার মানুষের সম্পর্কে বিশদ বিবরণ।
৬. ইবনে সাইদ আল-মাগরিবি (১২১৩-১২৮৬)
ইবনে সাইদ আল-মাগরিবি একজন আন্দালুসিয়ান ভূগোলবিদ ও পর্যটক ছিলেন। তিনি উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও স্পেন ভ্রমণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুগরিব ফি হুলা আল-মাগরিব’ (পশ্চিমের অলংকরণের অসাধারণ বই) ইসলামী বিশ্বের ভূগোল ও ইতিহাসের ওপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে বিভিন্ন শহরের বিবরণ ও মানচিত্র পাওয়া যায়।
৭. শামসুদ্দীন আল-মাকদিসি
বিখ্যাত ইসলামী ভূগোলবিদ ও পরিব্রাজক শামসুদ্দীন আল-মাকদিসি। ‘আহসানুন তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম’ তাঁর অন্যতম গ্রন্থ।
এই গ্রন্থ হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক ভৌগোলিক বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত। এটি লাইডেনের ইসলামিক জিওগ্রাফিক্যাল প্রকাশনা থেকে মুদ্রিত হয়।
তারপর আরো কয়েকটি সংস্করণ মুদ্রিত হয় এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়।
৮. ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬)
ইবনে খালদুন একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পর্যটক ছিলেন। তিনি তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে মিসর, মরক্কো ও আন্দালুসিয়া ভ্রমণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুকাদ্দিমা’ (প্রস্তাবনা) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সমাজের বর্ণনা পাওয়া যায়।
৯. ইবনে কাসির (১৩০১-১৩৭৩)
ইবনে কাসির একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদ ছিলেন। তিনি সিরিয়ার দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিসর, ইরাক ও হেজাজ ভ্রমণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ইসলামের ইতিহাস ও ভূগোলের ওপর একটি বিস্তৃত রচনা। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বের সমাজ ও সংস্কৃতির বর্ণনা পাওয়া যায়।
১০. আবু রায়হান আল-বেরুনী
আল-বেরুনীর সম্পূর্ণ নাম আবু রায়হান আল-বেরুনী বা আবু রায়হান মোহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনী। তিনি আল-বেরুনী নামে পরিচিত। তিনি ইসলামী স্বর্ণযুগের একজন পণ্ডিত ও বহুবিদ্যাবিশারদ ছিলেন।
১০১৭ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান মাহমুদের (৯৭১-১০৩০) দরবারে আসেন। ভারতে আক্রমণের সময় সুলতান মাহমুদের সঙ্গে আল-বেরুনী সেখানে কয়েক বছর অবস্থান করেন। গজনীর সুলতান মাহমুদের সঙ্গে সফরে যাওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর। আল-বেরুনী ভারত সম্পর্কিত সব কিছুর সঙ্গে পরিচিত হন। এই সময়ে তিনি ভারত পাঠ সম্পর্কে ‘ফি তাহকিকে মালইল হিন্দে মিন মাকালাতুন মুকবুলাতুন ফিল-আকলিয়েও মারজুলাতুন’ গ্রন্থটি লেখেন। বাংলায় বইটি ‘ভারততত্ত্ব’ নামে অনূদিত হয়েছে। এটি নানা দিক দিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ ও জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ। তিনি তাঁর সন্ধানী ও সংবেদনশীল দৃষ্টি দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ, তার অতীত ও বর্তমান, মানবসমাজের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ যেভাবে দেখেছেন তার একটি নিখুঁত ও নিরপেক্ষ বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন।