দেশে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের গড় উৎপাদন ব্যয় ৪৯ টাকা ৬০ পয়সা। গত আগস্টে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ২৩৬ টাকায়। তার মানে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে পৌনে ৫ গুণ বেশি দামে কাঁচা মরিচ কিনেছেন ভোক্তারা। সম্প্রতি কাঁচা মরিচের দাম আরও বেড়েছে। বাজারভেদে ২২০ থেকে ৩০০ টাকা। গত সপ্তাহে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে কাঁচা মরিচ।
এ ছাড়া প্রতি কেজি হলুদের উৎপাদন খরচ ৩৪ টাকা ৭৬ পয়সা। যদিও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি হলুদ গড়ে ৩২৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদন খরচের তুলনায় ৯ দশমিক ৩০ গুণ বেশি দামে হলুদ কিনতে হয়েছে ভোক্তাদের।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
নিত্যপণ্যের দাম ৯ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কম সরবরাহ, অদক্ষ বাজারব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ, বাজারের আধিপত্য, সীমিত দর-কষাকষির ক্ষমতার বিষয়টি গবেষণায় উঠে এসেছে।
ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণে গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণার এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বারের কার্যালয়ে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ।
ঢাকা চেম্বারের জরিপটি করা হয় চলতি বছরের আগস্টে দেশের ৮টি বিভাগের ৪৯টি জেলায়। এসব জেলার ৬০০ জনের কাছ থেকে জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। তাঁদের মধ্যে আছেন উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী। এতে ২১টি পণ্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ১২টি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত, ৫টি আমদানি এবং বাকি ৪টি স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি করা হয়।
সেমিনারে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে কয়েক গুণ দাম বাড়লেও উৎপাদকেরা পণ্যের ন্যায্য দাম পান না। কখনো কখনো মূল্যবৃদ্ধির জন্য পরোক্ষ খরচও দায়ী। আমরা যদি মজুত, পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারি, তাহলে দাম তুলনামূলকভাবে কমে আসবে।’ ট্যারিফ ক্যালেন্ডার প্রণয়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দেশীয় মৌসুম ছাড়াও পূর্বঘোষিত সময়সীমা অনুসারে আমদানি শুল্ক হ্রাস অথবা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সেমিনারে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন ঢাকা চেম্বারের নির্বাহী সচিব (গবেষণা) এ কে এম আসাদুজ্জামান পাটোয়ারি। তিনি বলেন, কৃত্রিম সংকট, ঋণপত্র খোলার সমস্যা, মৌসুমি পণ্যের মূল্যের তারতম্য, টাকার অবমূল্যায়ন, সরবরাহব্যবস্থায় অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত মজুতসুবিধা ও উৎপাদকদের সীমিত বাজারে প্রবেশাধিকার ইত্যাদি বিষয় পণ্যের দাম ওঠানামার জন্য দায়ী।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বিভাগভেদে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও খুচরা পর্যায়ে দামের ব্যবধান ২ হাজার শতাংশ হয়ে থাকে। যেমন হলুদের উৎপাদন ব্যয় ও খুচরা পর্যায়ে দামের ব্যবধান বরিশালে ২ হাজার ১১ শতাংশ, কাঁচা মরিচে ১ হাজার ১০০ শতাংশ, মসুর ডালে ১ হাজার ২০ শতাংশ, মোটা চালে ৫৬৬ শতাংশ, শুকনা মরিচে ৩৪৪ শতাংশ, রসুনে ২০৪ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি হওয়া নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয়ের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হয়। যেমন আদা প্রতি কেজি ১৭১ টাকা ৫৫ পয়সায় আমদানি হয়। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩৮ টাকায়। এ ছাড়া শুকনা মরিচ ২৯৫ টাকায় আমদানি হলেও খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৩৬৫ টাকায়।
সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সায়েরা ইউনুস বলেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে পণ্যের মূল্য কমানো সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারকে প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯ বার নীতি সুদহার পরিবর্তন করলেও বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস উইংয়ের যুগ্ম সচিব সাইফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘আমাদের বার্ষিক পণ্যভিত্তিক কোনো প্রোডাক্ট ক্যালেন্ডার বা পণ্য দিনপঞ্জি নেই। পরিসংখ্যানভিত্তিক এমন দিনপঞ্জি থাকলে সরকারের পক্ষে পণ্য আমদানি, শুল্কায়নসহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হতো।’ তিনি আরও বলেন, দেশে প্রতিবছর আবাদি জমি ১ শতাংশ হারে কমছে। এ কারণে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে কৃষি খাতে ভর্তুকি ৪-৫ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এই ভর্তুকি ১০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মো. মশিউল আলম বলেন, ট্যারিফ ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা গেলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মৌসুমে শুল্ক কমানো বা বৃদ্ধি করা যাবে। এতে স্থানীয় উৎপাদকেরা উপকৃত হবেন। একই সঙ্গে আমদানিপ্রক্রিয়াও সহজতর হবে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপপরিচালক স্বজন হায়দার। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি মো. জুনায়েদ ইবনে আলী।