৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সিলেটের জনপ্রিয় দুই পর্যটন কেন্দ্র গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর থেকে চলছে নির্বিচারে পাথর লুটপাট
সরকার পতনের পর প্রথম তিন দিনে জাফলং ও সাদাপাথর থেকে লুট হয়েছে ২০০ কোটি টাকার পাথর। এখনও চলছে লুটপাট।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালীরা শত শত শ্রমিক লাগিয়ে রাতদিন অবৈধভাবে এ পর্যটন এলাকার পাথর উত্তোলন করিয়েছে। লুটের কারণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে এই দুই পর্যটনকেন্দ্র।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম গনমাধ্যকে বলেন ‘সরকার পতনের পর প্রথম তিন দিন পুলিশসহ অনান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল। এই সুযোগে জাফলং থেকে প্রায় ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।’
কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা বলেন, ‘সাদাপাথর থেকে লুট হয়েছে ২০ কোটি টাকার পাথর। আর শাহ আরেফিন টিলা থেকে আরও প্রায় ২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।’
তবে স্থানীয়দের দাবি, দুই কোয়ারি থেকে ১৪০ কোটি নয়, ২০০ কোটি টাকার ওপরে পাথর লুট হয়েছে।
পরিবেশের সুরক্ষা ও পর্যটক আকর্ষণ ধরে রাখতে ২০১৬ সালে এ এলাকায় পাথর উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা জারি করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়। এর আগে ২০১২ সালে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীসহ ১৫ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ-সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়, ‘অপরিকল্পিতভাবে যেখানে-সেখানে পাথর উত্তোলন ও নানাবিধ কার্যকলাপের ফলে সিলেটের জাফলং-ডাউকি নদীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংকটাপন্ন, যা ভবিষ্যতে আরও সংকটাপন্ন হবে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। …ইসিএভুক্ত এলাকায় যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যেকোনো খনিজ সম্পদ উত্তোলন নিষিদ্ধ।’
মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত কয়েক বছর বন্ধ ছিল পাথর উত্তোলন। ফলে জাফলংয়ের পিয়াইন ও কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর উৎসমুখে (সাদাপাথর) বিপুল পরিমাণ পাথর মজুত হয়েছে। স্রোতের তোড়ে উজান থেকে আসা পাথর স্তরে স্তরে মজুত হয় দুই নদীর উৎসমুখে। এসব পাথরের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে জাফলং ও সাদাপাথরে পর্যটক সমাগম বাড়ছিল।
ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জাফলং দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি। এখানে অনিয়ন্ত্রিত বালু-পাথর উত্তোলনের ফলে পর্যটনকেন্দ্রটির সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও হুমকির মুখে। ইসিএ ঘোষিত জাফলং থেকে সব ধরনের বালু ও পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ।
‘তবে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও একটি গোষ্ঠী বালু ও পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে জাফলংয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’
লুটপাট বন্ধে জাফলং, সাদাপাথর, লোভছড়া, ভোলাগঞ্জ ও শাহ আরেফিন টিলায় প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালিয়ে পাথর জব্দ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
স্থানীয় দুজন পাথর ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লুটপাট এখনও চলছে। প্রতিদিনই শত শত ট্রাক দিয়ে জাফলং ও সাদাপাথর থেকে পাথর পরিবহন করা হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযানে তার সামান্যই ধরা পড়ছে।
তাদের একজন বলেন, ‘এখন জাফলং গেলে দেখা যাবে কেবল ট্রাক আর ট্রাক। ট্রাকের কারণে ধুলোয় ধূসর পুরো এলাকা। এখন এখানে পর্যটক তো নেই-ই, ধুলোর কারণে স্থানীয়দেরও হাঁটাচলার সুযোগ নেই।’
গত ৬ নভেম্বর সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে মো. ইসমাইল হোসেন নামে জাফলংয়ের এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে চলছে পাথর লুট।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দুই কোয়ারিতে বালু ও পাথর লুটের সাথে জড়িত প্রভাবশালীদের বেশিরভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
জাফলংয়ের পিয়াইন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের প্রমাণ পেয়ে দলীয় পদ হারান জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ।
এছাড়া পাথর লুটের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সদ্য অপসারিত চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্সসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতার নাম জড়িয়েছে।
জাফলংয়ে পাথর লুটের ঘটনায় বিএনপির এই তিন নেতাসহ ১১৪ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট থানায় একটি ও পরিবেশ আদালতে অপর মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু লুটের ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় তিনটি ও কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের হলেও মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গনমাধ্যমে বলেন, ‘পাথর লুটের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে। লুটপাট বন্ধে নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে।’
এদিকে পাথর নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই পাথর উত্তোলন চালুর দাবিতে আন্দোলনে নামেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। তবে তৎকালীন সরকার এ দাবি আমলে নেয়নি। নতুন সরকার আসার পর আবার একই দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
এই দাবিতে গত ২৩ অক্টোবর জাফলংয়ে বিশাল মানববন্ধন করা হয়। এতে বিভিন্ন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সমিতি অংশ নেয়।
পাথর উত্তোলনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে জাফলং ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও সামাজিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন খাঁন আনু বলেন, ‘জাফলংসহ সব পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন, সংগ্রহ ও সরবরাহ করে দেশের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এই পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বেকার হয়ে পড়েছেন পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।’
পাথর উত্তোলনে পরিবেশের উপকার হয় দাবি করে আনু বলেন, ‘প্রতি বছরই ঢলের সাথে প্রচুর পাথর ভারত থেকে এই এলাকায় এসে জমা হয়। এসব পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে ঘন ঘন বন্যা দেখা দিচ্ছে। তাই পরিবেশের স্বার্থেই পাথর উত্তোলন করা প্রয়োজন।’
তবে ব্যবসায়ীদের এসব দাবির সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়ে সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ, জাফলংয়ে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও পাথর ভাঙার মেশিন নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সিলেটের পরিবেশকর্মীরা।
এসব দাবিতে সিলেটের জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে লুটপাট করে জাফলং ও সাদাপাথরকে পাথরশূন্য করে ফেলা হয়েছে। এখন আবার পাথর উত্তোলনের দাবিতে মাঠে নেমেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের এই দাবি মানা হলে এসব পর্যটন এলাকা আবার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশারাফুল কবির বলেন, দেশে চাহিদার তুলনায় খুব সল্প পরিমাণ পাথর সিলেটের কোয়ারিগুলোতে পাওয়া যায়। ‘ফলে বড় অংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। তাই পাথর কোয়ারি খুলে দিলে আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন দাবি সত্য নয়। কোয়ারি সচল হলে কিছু মানুষ আর্থিকভাবে লাভভান হতে পারেন, কিন্তু দেশের বিরাট ক্ষতি হবে।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদ বলেন, ‘পাথর কোয়ারি সচল করা হবে কি না, এটি সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এখন পর্যন্ত সরকার থেকে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ফলে যারা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’