পর্যটন সংবাদ ডেস্ক: ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত লুভর মিউজিয়াম শুধু একটি জাদুঘর নয়, এটি বিশ্ব সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। ১২শ শতকে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্ট সাইন নদীর তীরে প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে এর ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এটি রাজপ্রাসাদে রূপান্তরিত হয় এবং ফরাসি রেনেসাঁ যুগে রাজারা এটিকে ধীরে ধীরে শিল্প ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করেন। বিশেষত, ফ্রান্সিস প্রথম রাজত্বে ইতালীয় শিল্পকর্ম সংগ্রহ শুরুর মধ্য দিয়ে এর জাদুঘর হিসেবে বিবর্তন শুরু হয়।
১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং লুভর জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন সংগ্রহে ছিল মাত্র ৫৩৭টি চিত্রকর্ম। সময়ের সাথে সাথে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও সমৃদ্ধ জাদুঘরে পরিণত হয়। বর্তমানে লুভরে ৩৫ হাজারেরও বেশি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মোনা লিসা, ভেনাস দ্য মিলো, উইংড ভিক্টরি অব সামোথ্রেস ও নেপোলিয়নের অ্যাপার্টমেন্টসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।
১৯৮৯ সালে লুভর তার আধুনিক রূপ লাভ করে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি আই. এম. পেই এর নকশায় নির্মিত কাচের পিরামিড লুভরের প্রবেশপথ হিসেবে স্থাপিত হয়, যা আধুনিক ও ঐতিহ্যের যুগলবন্দী হিসেবে আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এই স্থাপত্য শুধু লুভরের পরিচায়ক নয়, বরং এটি আধুনিক মিউজিয়াম ব্যবস্থাপনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
২০২৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে ‘নুভেল রেনেসাঁ’ নামে একটি বড় ধরনের সংস্কার প্রকল্প। এর আওতায় মোনা লিসার জন্য আলাদা গ্যালারি তৈরি করা হচ্ছে, থাকবে নতুন প্রবেশপথ, উন্নত ভেন্টিলেশন ও এলিভেটর, আরও সহজে বোধগম্য নির্দেশিকা, টয়লেট ও সাইনেজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। এতে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা যেমন উন্নত হবে, তেমনি ভিড় সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ আরও দক্ষ হবে। তবে সমালোচকরা বলছেন, আলাদা কক্ষ ও সময় নির্ধারণের মাধ্যমে ‘মোনা লিসা’ সাধারণ দর্শকদের জন্য দূরগম্য হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে লুভরে প্রবেশের সাধারণ টিকিট মূল্য ২২ ইউরো হলেও ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়তে পারে, বিশেষ করে ইউরোপের বাইরের দর্শনার্থীদের জন্য। ফ্রান্স সরকার এই সংস্কার প্রকল্পে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত ব্যয় করতে যাচ্ছে, যার একটি অংশ বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছ থেকে আদায় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
লুভর মিউজিয়াম সপ্তাহে ছয় দিন খোলা থাকে (মঙ্গলবার বন্ধ) এবং সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। বুধবার ও শুক্রবার রাতে এটি ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে, যেটি তুলনামূলকভাবে ভিড় কম থাকার জন্য আদর্শ সময়। প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার সন্ধ্যায় ফ্রি এন্ট্রির সুযোগ থাকে, যা অনেক পর্যটকের জন্য দারুণ একটি সুযোগ।
লুভরে প্রবেশের জন্য প্রধান কাচের পিরামিড ছাড়াও ‘Carrousel du Louvre’ এবং ‘Porte des Lions’ নামক দুটি বিকল্প প্রবেশপথ রয়েছে। মেট্রো রুটে ‘Palais Royal – Musée du Louvre’ বা ‘Pyramides’ স্টেশন থেকে সহজে লুভরে পৌঁছানো যায়। এছাড়া বাস, ট্যাক্সি বা ভাড়া গাড়ির মাধ্যমেও এখানে যাওয়া যায়।
বিশ্বের সর্বাধিক দর্শকসংখ্যার অধিকারী লুভর মিউজিয়াম প্রতিবছর প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন পর্যটককে স্বাগত জানায়। তাই ভ্রমণের আগে অনলাইনে টিকিট নিশ্চিত করা এবং গাইড বুকিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্কিপ দ্য লাইন’ সেবা ব্যবহার করে সময় বাঁচানো যায় এবং অভিজ্ঞতা হয় আরও স্মরণীয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, লুভর শুধু শিল্পপ্রেমীদের জন্য নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আর্কিটেকচারের অনুরাগীদের জন্য এক অনন্য গন্তব্য। প্যারিস ভ্রমণে এটি এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে—যা যুগ যুগ ধরে বিশ্ব পর্যটনের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে থাকবে।