প্রকৃতিতে জানান দিয়ে অগ্রহায়ন আসলো শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে । সকালটা আজ শুরু হয়েছে মিঠেকড়া সোনালি রোদের মধ্য দিয়ে। চারিদিকে ফসলের মাঠে মাঠে পাকা ধানের ম–ম গন্ধ বয়ে বেড়াচ্ছে । সূর্যের আলোয় কৃষকের পাকা আমন ধানের শিষে জমা শিশিরের বিন্দু চিকমিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এ -যেনো এক অপরুপ দৃশ্য গ্রাম বাংলা জুড়ে ।
হেমন্তের শিশিরভেজা স্নিগ্ধ সকালেই উৎসবমুখর আয়োজনে আজ রোববার বগুড়ায় জমে উঠেছে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলা। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদী তীরবর্তী উথলী হাটে বসা দিনব্যাপী এই মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল হরেক পদের মাছের সমাহার। কাকডাকা ভোর থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে জমজমাট হয়ে ওঠে এই মেলা। এবারও সারি সারি দোকানে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ী ও খামারিরা। দিঘি, পুকুর, খাল-বিল আর নদ-নদী থেকে আনা বড় রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, বোয়াল, বিগ হেডসহ নানা মাছ দোকানে দোকানে সাজানো। মাছ কিনতে দূরদূরান্ত থেকে সাতসকালে মেলায় ভিড় করেন ক্রেতারা। মেলাজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রধান আকর্ষণ মাছ হলেও ছিল ঝুড়ি, জিলাপি, কদমা থেকে শুরু করে হরেক মিঠাই-মিষ্টান্ন। শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা, চরকি ও খেলনার দোকান।
আয়োজকেরা জানান, করতোয়া নদীতীরবর্তী প্রাচীন জনপদ বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি গ্রামে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে অগ্রহায়ণ মাসে এই নবান্ন মেলা বসে। মেলা উপলক্ষে উথলি ছাড়াও ছোট নারায়নপুর, বড় নারায়নপুর, রথবাড়ি, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদনীপাড়া, বাকশন, রহবল, আকন্দপাড়া, জাবাড়িপুর, ছয়ঘড়িয়া, পাইকপাড়াসহ আশপাশের অন্তত ৩০টি গ্রামে বিরাজ করছে অন্য রকম উৎসবের আমেজ। আত্মীয়স্বজনকে নিয়ন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মেয়েরা নাইওর এসেছেন বাবার বাড়িতে, জামাতারা এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে।
মেলা আয়োজক কমিটির একজন সদস্য বলেন, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক দোকানে হরেক মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। ভোর রাত থেকে চলছে বেচাবিক্রি। প্রতিটি দোকানে বাহারি সব মাছের সমাহার। মেলায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ১৭ কেজি ওজনের ব্ল্যাক কার্প মাছ। প্রতি কেজি ৮০০ টাকা দরে এ মাছ বিক্রি করেছেন মোকামতলা বাজারের মাছের ব্যবসায়ী মানিক মিঞা।
মেলায় আট কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ আট হাজার টাকায় কেনেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের সাজ্জাদ আলী। তিনি বলেন, নবান্ন উপলক্ষে মেলা বসলেও এখানকার খ্যাতি মূলত মাছ আর নতুন আলুর জন্য।
মাছ বিক্রেতা মানিক মিঞা বলেন ১৭ কেজি ওজনের একটি কার্প মাছ বিক্রি করেছেন ১৩ হাজার ৫০০ টাকায়। আনিছার রহমান বলেন, অন্য বছর বগুড়া, নাটোর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মেলায় বড় বড় মাছ বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীরা আসতেন। এ বছর বড় মাছের সরবরাহ কম। দামও বেশি। এবারে ছোট ও মাঝারি রুই-কাতলা গড়ে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। চিতল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা দরে। এ ছাড়া ব্ল্যাক কার্প ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, বড় আকারের কাতলা মাছ গড়ে প্রতি কেজি ১০০০, রুই ৮০০, বিগ হেড ৭০০ টাকা কেজি দরে বেচাবিক্রি হয়েছে। পাঙাশ বিক্রি হয়েছে গড়ে ৩০০ টাকা দরে।
নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা সত্যেন্দ্রনাথ সাহা বলেন, ২০০ বছর ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নবান্ন উৎসবকে ঘিরে করতোয়া নদী তীরের জনপদ উথলিতে নবান্নের মেলা বসছে। কালের বিবর্তনে কিছুটা জৌলুশ হারালেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নবান্নের এই মেলা। মেলা থেকে কেনা মাছ ছাড়াও নতুন চালের ক্ষীর ও পায়েস এবং নতুন আলুর তরকারির সঙ্গে গরম ভাতে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করেন এ এলাকার মানুষ।
সনাতন ধর্মের লোকজনের কাছে নবান্ন আয়োজনের অনুষঙ্গ নতুন আলু, মিষ্টি আলু, খেতের শাকসবজি, কেশুর, পানিফল। মেলায় এবারও এসব অনুষঙ্গের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।
এবার প্রতি কেজি নতুন পাকড়ি আলু মেলায় বিক্রি হয়েছে আকারভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। মিষ্টি আলু ও কেশর বিক্রি হয়েছে ২০০-২৫০ টাকায়। মেলায় বসেছে দই, চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, কদমা-বাতাসা, নিমকি, মিঠাই-মিষ্টান্ন, ঝুড়ি, জিলাপিসহ হরেক মিঠাই-মিষ্টান্নের দোকান। শিশুরা নাগরদোলায় চড়ছে, হরেক খেলনা কিনছে। নারীরা ভিড় করেছেন আলতা-চুড়ির দোকানে।
উথলী মেলার ইজারাদার মো. পিয়াস বলেন, মাছ কিনতে আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভিড় করেছেন ক্রেতারা। ভোর থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে গভীর রাত পর্যন্ত। এবার মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতার সরগরম ভালো হলেও মাছের সরবরাহ কম। দামও তুলনামূলক এবার বেশি।