‘বুঝলেন এসব বেতন-টেতনের কোনো অভিযোগ করে বড় কিছু করতে পারবেন না। কে, কত বড় অঙ্কের বেতন পেলো সেটা আপনার দেখার দরকার নেই। …মাঠে নেমে গেছেন। এখন আপনি পেশাদার সাংবাদিক। যিনি ২০ বছর আগে মাঠে সংবাদ সংগ্রহ করছেন তার সঙ্গে আপনার লড়াই। এ যুদ্ধে যেদিন নিজেকে প্রমাণ করবেন সেদিন আসবে কাঙ্ক্ষিত বেতন।’
কথাগুলো অনুপ্রেরণাদায়ী হওয়ার কথা। সেটা চাবুকের মতো কাজ করেছে সেদিন। সেদিনই বটে। অঘোর দাদা মাঠে যাওয়ার আগে যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন তাতে বুকের সিনা টানটান হয়েছে। মাঠে নেমে ২০ বছরে আমি বা আমার আরও অনেকে কী করেছি তা জানি না। কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতার হাতেখড়ি অঘোর মন্ডলের হাত থেকে পাননি আমাদের এ তল্লাটে এমন লোক অন্তত ১২ বছরের মধ্যে এই পেশায় ঢুকেছেন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
অঘোরদা একাধারে বহুমাত্রিক ক্রীড়া প্রতিবেদক। মাঠে তাকে দেখলেই কর্মকর্তাদের বুক শুকিয়ে যেত। আবার ফিচার পাতায় গ্যালারিতে যখন বিশাল বিশাল লেখাগুলো লিখতেন, তখন মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম-কীভাবে সম্ভব! সেই মুগ্ধতা সময়কালে আরও বেড়েছে।
তিনি রাজনীতির বিশেষ পাঠে ছিলেন দক্ষ এবং অগ্রজ। এই তো সেদিন দীপ্ত টেলিভিশনে রাজনীতির মাঠের বাঘা বাঘা মানুষদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন তিনি। ওই যে বলছিলাম বহুমাত্রিক, এই কার্যকরী ব্যাখ্যা বোধহয় এটাই।
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। ভোরের কাগজের দিনগুলোয় তাকে গুরু হিসেবে পাওয়া দুই যুগেরও বেশি সময় পর উপলব্ধির স্নায়ুতে উষ্ণতা বইয়ে দেয়। চোখ বুজলেই দেখতে পাই কাচ্চা-বাচ্চা আমি, স্লিপের লেখাগুলো ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। রাগের চোটে কথা হারিয়ে গেছে অঘোরদা’র মুখ থেকে।
একবার রুবেল আবিদ (প্রথম আলোয় কর্মরত) ও আমাকে পারলে তো স্ট্যাপলার ছুঁড়ে মেরে বসতেন। প্রথমদিকে ভাবতাম একি! কোন মাস্টার মশাইয়ের হাতে পড়লাম। তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তগুলো।
আঁতে তো ঘা লাগেই। কিন্তু যত সময় গেছে অঘোরদা’র কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছি কোথায় ‘সঙ্গে’ হয়, আর কোথায় ‘সাথে’ হয়। কীভাবে দুই দলের লড়াইয়ে ‘বিপক্ষে’ বসে। আর অভিযোগের সঙ্গে বসে ‘বিরুদ্ধে’।
অনেক ছোট ছোট শিক্ষা। সেগুলো কতটা মন দিয়ে শিখেছি তা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু অধুনা ক্রীড়া সাংবাদিকতার আটপৌরে লেখার মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এসব ভুল নিয়মিত হচ্ছে। আফসোস লাগে তখনই। অঘোরদা যদি তাদেরও দায়িত্ব পেতেন!
অঘোরদা’র অনেক গুণের মধ্যে ছিল গুরু হিসেবে শেখানো। শুধু তাই নয়। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নিজের ডায়েরি বজায় রাখা, আগামী দিনের পরিকল্পনা কী, সেসব বলে বলে ধরিয়ে দেওয়া। সাক্ষাৎকারে কীভাবে প্রশ্ন সাজিয়ে নেওয়া উচিত সেসব গাইডলাইন ছিল এক কথায় অসাধারণ।
অঘোরদা একাধারে বহুমাত্রিক ক্রীড়া প্রতিবেদক। মাঠে তাকে দেখলেই কর্মকর্তাদের বুক শুকিয়ে যেত। আবার ফিচার পাতায় গ্যালারিতে যখন বিশাল বিশাল লেখাগুলো লিখতেন, তখন মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম-কীভাবে সম্ভব! সেই মুগ্ধতা সময়কালে আরও বেড়েছে।
আমার ছোট কর্ম জীবনে অঘোরদা ছাড়াও মাথার ওপর ছাতা হিসেবে পেয়েছি আরও বেশ কয়েকজন গুণীকে। আরিফ রহমান শিবলী ভাই তো ম্যানেজার হিসেবে অতুলনীয়। পরাগ আরমান ভাই বা নাসিমুল হাসান দোদুল ভাইরা টেলিভিশনের ততদিনের নামী রিপোর্টার।
ভোরের কাগজ থেকে দারুণ এক প্রস্তাবে আমি এক বছরের মাথায় যখন দৈনিক জনকণ্ঠে যাই, তার আগে অঘোরদা’র সঙ্গে আমার আলাপের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি কখনোই চাইতেন না যে তার সঙ্গে কাজ করা লোকজন যেন অন্য জায়গায় চলে যান। কিন্তু ভোরের কাগজের বেতনাদি বৃদ্ধির অক্ষমতা তার আর্তিকে করুণ থেকে করুণতর করেছে প্রতিনিয়ত।
জনকণ্ঠে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, আরও শানিত হওয়ার আগে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে যা শেখানোর চেষ্টা করেছি সেগুলো যদি ঠিকঠাক বুঝে থাকেন তাহলে বেশ দূরে যেতে পারবেন। একথা কানে বেজে যাচ্ছে অবিরত। তিনি নেই।
তার দেওয়া বর্ষণ কবির নামটার দিকে তাকিয়ে কয়েক রাত ঘুমাতে পারিনি। তিনি যে মহাকালের যাত্রায় গেছেন, তাতে রেখে গেছেন অনেক দারুণ কাজের স্মৃতি। পরিবার, দুই মেয়ে।
রেখে গেছেন শেখ রাশেদুল কবির বর্ষণকে, ‘বর্ষণ কবির’ নামে। অঘোরদা এসব ‘পেন নেম’-এ দারুণ সিদ্ধহস্ত। শুরুর দিকে ফিচার পাতায় একটা লেখায় নিজের রাশেদুল কবির নামটা দিয়েছিলাম। পরেরদিন পত্রিকা খুলে চোখ কপালে। সময়কাল ২০০৪ সালের আগস্টে। হতভম্ব আমি সন্ধ্যায় পাতা মেকআপের সময় গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রিন্টিংয়ে কোনো ভুল ছিল কি না। টেনে টেনে উত্তর দেওয়ার একটা সিগনেচার স্টাইল ছিল অঘোরদা’র।
‘শোনেন। এ নামটাই মানুষ মনে রাখবে।’ তিনি আমার শিক্ষকতুল্য। আর কথা বাড়ায়নি। সেই যে নাম প্রতিষ্ঠা পেলো, সেটাই হয়তো এখন তার সবচেয়ে বড় স্মৃতি বয়ে বেড়ানো হবে আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে।
অনেকটা সময়ই অঘোরদা’র শরীর খারাপ করতে থাকতো। এই ডাক্তার-হাসপাতাল করে কয়েক বছর আগে যমের দুয়ার থেকে ফিরেছিলেন। এবারও ভেবেছিলাম তার মতো চনমনে মানুষকে কিডনি বিকল করে ফেলে রাখতে পারবে না। কিন্তু সব হিসাব বদলে দিয়েছে ডেঙ্গু।
শেষের দিকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। জ্ঞান ফিরতো না ঠিক মতো। কথা হতো তার বড় মেয়ের সঙ্গে। অরুণিমা অনেক শক্ত মেয়ে। অঘোরদা’র মতোই। বৌদি একদিনই কথা বলেছিলেন। আমার হাতের মোবাইল স্থির থাকেনি। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যেন, এ যাত্রা অন্তিম হচ্ছে অঘোর দা’র।
আশায় বুক বেঁধেছি। তিনি যে ক্রীড়া সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সেই বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এ সাধ্যমতো থাকার চেষ্টা করেছে। এর সঙ্গে তার দেশ-বিদেশে অগণিত মানুষের আশীর্বাদ তো ছিলই। সবকিছু মিলিয়ে অঘোরদা’র না ফেরার কোনো কারণ আমার মাথায় খেলা করেনি। কিন্তু দিন গড়ায়। রাত আসে।
ডায়েলাইসিস করতে গিয়ে তাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে আর বের করা হয় না। যে অনমনীয় মানুষটাকে আমি চিনতাম তিনি হয়তো মনের সবচেয়ে বড় জোরটা দিয়ে চোখ মেলে তাকাতেন কখনো কখনো শরীরে ভয়ঙ্কর সব বেদনা নিয়ে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। এই শরীর খারাপটাই মাথা খারাপ করে দেওয়ার দুঃসংবাদ দিলো ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে। অঘোরদা নেই। এটা মানা কঠিন।
কেন কঠিন? দুই দশকের ক্যারিয়ারে আমার দেখা অন্যতম প্রাণবন্ত মানুষটাই তিনি। এই আবাহনী ক্লাবে ববি ভাইদের সঙ্গে আড্ডা মারছেন তো ছুটছেন ধানমন্ডি চার নম্বর মাঠে। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন প্রায় এক দশক। কী কারণ, সে ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। যখন এটিএন নিউজ হয়ে দীপ্ত টিভিতে, তখন তিনি শুধু ক্রীড়া সম্পাদক নন, কাজের চাপটাই তার হাত-পা চেপে রেখেছিল হয়তো।
অঘোরদা’র অনেক গুণের মধ্যে ছিল গুরু হিসেবে শেখানো। শুধু তাই নয়। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নিজের ডায়েরি বজায় রাখা, আগামী দিনের পরিকল্পনা কী, সেসব বলে বলে ধরিয়ে দেওয়া। সাক্ষাৎকারে কীভাবে প্রশ্ন সাজিয়ে নেওয়া উচিত সেসব গাইডলাইন ছিল এক কথায় অসাধারণ।
মাঠের অঘোরদা’কে শেষবার দেখেছিলাম দেশের বাইরে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা ও ছবি তোলার সময়। এরপর অনেকবার কথা হয়েছে। বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসজেএ) পিকনিকে সপরিবারে তাকে দেখেছি সেটাও বেশ অনেক মাস আগে। কিন্তু একা একা অঘোরদা’র সঙ্গে পরামর্শ করার সময়টা আগের বছরের মতো সম্প্রতি হয়ে ওঠেনি।
একটা সময় ছিল যখনই কোনো সমস্যা, তখনই তার কাছে পরামর্শ নেওয়া আমার রীতি হয়ে উঠেছিল। টেলিভিশন প্রতিবেদনের স্ক্রিপ্টে তিনি কেন যেন আমাকে বারবার বলতেন, আরও ভালো কিছু করতে হবে। আশেপাশের ডিজিটাল কীর্তিতে হতাশা প্রকাশ করা অঘোরদা আক্ষেপও করতেন কোথাকার সাংবাদিকতা কোথায় গিয়ে নেমেছে।
গুরুগম্ভীর অনেক আলোচনা চলতো মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা। শুধু আমি নই। এমন অনেক প্রতিবেদক আছে, যারা তার সঙ্গে কথা না বলে ঘুমাতে যেত না বলেও আমি শুনেছি। ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য।
অঘোরদা’র মুখাগ্নি হয়ে গেছে যখন লেখাটা লিখছি। আমি সেই দৃশ্য দেখবো না। তার নিথর দেহ দেখার সাহস আমার নেই। আমি শবযাত্রায় যাইনি। যে অঘোরদা’কে আমি দেখেছি, সাহসী, অদম্য রূপে তাকে এভাবে শুয়ে আছে দেখাটা আমার জন্য দুঃসাহসিক কাজ।
মাত্র ক’দিন আগেই উৎপল শুভ্রদা ও আমি আলাপ করছিলাম তার শারীরিক সমস্যা নিয়ে। কীভাবে তিনি আমাদের মাঝে ফিরতে পারেন সেটা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপের পর কে জানতো, তার জীবনের রেখাটা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার মিলছে না। অঘোর মন্ডল ছাড়া বিএসজেএ বা অন্য কোনো আড্ডা কেন যেন বেমানান। পুরো দুনিয়ার এই একটা মানুষকেই আমি মেনেছি নিজের গুরু হিসেবে। অন্যলোকে প্রেসবক্সে আবার তার সঙ্গে দেখা হবে। আমিসহ আরও অনেকেই তার সঙ্গী হবো। আড্ডা হবে। বিশ্লেষণ হবে। ততদিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে গুরু হারানোর শোক।
বর্ষণ কবির ।। ক্রীড়া সাংবাদিক
(লেখাটি স্বনামধন্য একটি অনলাইন পত্রিকা থেকে নেয়া)